অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরির কথা শোনেনি এমন পাঠক পাওয়া বেশ বিরল বলা চলে। ৭৮ বছর আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলা কালে জার্মানদের দখলকৃত নেদারল্যান্ডসে পরিবারসহ আত্মগোপন করে থাকা তের বছরের এক ইহুদি কিশোরীর দিনলিপি এই বইটি। এ্যান্থনি বেভোরের ‘দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার’, মার্কুস জুসাকের ‘দ্য বুক থিফ’ জন বয়েনের ‘দ্য বয় ইন দি স্ট্রাইপড পাজামাস’ এর মতো উল্লেখযোগ্য সব বই থাকার পরেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ও যুদ্ধ সাহিত্যের অন্যতম দলিল হয়ে উঠেছে এই অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি। তাই ১৯৪৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়া এই বইটিকে সোজা-সাপটাভাবে শুধুই দিনলিপি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ১৯৫২ সালে আমেরিকাতে প্রথমবার যখন অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন বইটি প্রথম মুদ্রণে পাঁচ হাজার কপি, দ্বিতীয় মুদ্রণে পনের হাজার কপি আর তৃতীয় মুদ্রণে পঁয়তাল্লিশ হাজার কপি প্রকাশ করা হয়। এভাবেই ক্রমে বইটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, এবং মাত্র কয়েক বছরের ভিতরেই বইটির লক্ষাধিক কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। ২০১৫ সালে ‘অ্যানা ফ্রাঙ্ক ফন্ডস’ এর রেকর্ড অনুযায়ী, বিশ্বে ৬০ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বইটি।
১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর অ্যানার পরিবার জার্মানি থেকে চলে আসে হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে। অ্যানার বাবা সেখানেই গুছিয়ে নেন তার ব্যবসা। বাবা অটো ফ্র্যাঙ্ক, মা এডিথ ও বড় বোন মার্গটকে নিয়ে অ্যানার পরিবার। ১৯৪২ সালে নিজের তেরতম জন্মদিনে অ্যানা ফ্র্যাংক উপহার পায় একটি লাল-সাদা চেকের ডায়েরি। যা সে আগেই পছন্দ করে এসেছিল বইয়ের দোকান থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন ইহুদি নিধন শুরু হয়, নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে ভেতরে ভেতরে আতংকগ্রস্থ হয়ে ওঠে সকলেই। এমন সময় জুলাই মাসের একটি দিনে অ্যানার বড় বোন মার্গটের কাছে আসে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দেওয়া চিঠি। সেই চিঠি পেয়ে তৎক্ষণাৎ ফ্র্যাঙ্ক পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় আত্মগোপন করার। তের বছরের কিশোরীর চেনা জগত যেন নিমিষেই মঞ্চের ভারী পর্দার মতো দুলে ওঠে। সে নিজেও জানে না পর্দার অন্য পাশে তার জন্য আগামীতে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি আর কী কী অপেক্ষা করছে। তাই বন্ধু মর্যাদা দেওয়া ডায়েরিটিকে সঙ্গী করে অ্যানা লিখে যায় তাদের গুপ্ত জীবনের নানা অভিজ্ঞতা। নিজের ডায়েরিটি সে সম্বোধন করত ‘প্রিয় কিটি’ নামে, এবং মনের কথা লেখা শেষে হলে লিখত ‘ইতি তোমার অ্যানা’। অ্যানার পরিবার বাদে তাদের সাথে আশ্রয় নিয়েছিল অটো ফ্র্যাঙ্কের ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত থাকা আরেকটি ইহুদি পরিবার। মিঃ ভ্যান ডান, তার স্ত্রী ও একমাত্র টিনেজ পুত্র পিটার। এবং পরবর্তীতে একজন দন্ত চিকিৎসক যার নাম মিঃ ডুসেল। অ্যানার বাবার ছয়জন সহকর্মী আত্মগোপনের সময়ে নানাভাবে ঝুঁকি নিয়ে, কিন্তু আকুন্ঠ চিত্তে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করে গিয়েছে তাদের। প্রথমদিকে অ্যানা শুধু নিজের জন্য ডায়েরি লিখত। পরে ১৯৪৪ সালে একদিন ডাচ গভরমেন্ট বলকেইস্টেইন রেডিওতে ঘোষণা দেন, যুদ্ধ শেষ হলে বিভিষীকাময় অধ্যায়ের চাক্ষুষ সাক্ষীদের দূর্দশা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উনি ডায়েরি এবং চিঠির কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে অ্যানা সিদ্ধান্ত নেয়; যুদ্ধের পর তার ডায়েরিটি বই আকারে প্রকাশ করবে। এবং সেই আশাকে আঁকড়ে ধরে; অ্যানা আবার নতুন করে তার ডায়েরির খুঁটিনাটি লিখতে এবং ঠিকঠাক করতে শুরু করে।
একটি তের বছরের কিশোরীর জীবন খোলাচোখে আমাদের কাছে বেশ সহজাত। ছিমছাম। অ্যানার জীবনটাও তাই ছিল। ছোটবেলা থেকেই বুদ্ধিদীপ্ত, বইপড়ুয়া অ্যানাকে আমরা পাই সর্বত্র উড়ে বেড়ানো, চটপটে, চঞ্চল কিশোরী হিসেবে, আর সব মেয়েদের মতোই। কিন্তু সেই কিশোরীটির জীবন যখন চেনা দৃশ্য থেকে আচমকা বদলে যায়, তখন আসলে কী হয়? আতংক এবং অনিশ্চয়তা দেয় হানা, পাল্টে যায় অনেক কিছু। যার প্রভাব পড়ে যে কারও চেতন এবং অবচেতন মনে। তাই অ্যানার ডায়েরি ও তার মনস্তাত্ত্বিক জগতকে আমরা যদি তিনটি ভাগে ভাগ করে নেই; তাহলে আমরা দেখি, একটি কিশোরীর ভাবনার অতল জগত, ক্রমশ তার কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত তার নিজেকে আবিষ্কারের ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও একটি নির্মল পৃথিবীর স্বপ্ন।
বইটি আমি প্রথম পড়ি বেশ অনেক বছর আগে। একদিন; এক বিকেলে বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে ছোট খালা হাতে তুলে দেয় ‘অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি’-র অনুবাদ বই। বইয়ের মাঝের কিছু পাতা স্ট্যাপলার দিয়ে আটকে রাখা। আমাকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল আরেকটু বড় হয়ে মাঝের পাতাগুলো পড়া যাবে। আমি যদিও তখন বনোফুলের ‘পাঠকের মৃত্যু’ লেখাটি পড়িনি। তবে এগার কিংবা বারো বছর বয়সী জীবনে, চারপাশের কারও সেই সময় কিংবা ক্ষমতা ছিল না, যা আমার আদম্য আগ্রহকে দমিয়ে রাখবে। তাই নির্জন দুপুরে বাড়ির সকলে যখন ভাতঘুম দিতে, পত্রিকা পড়তে কিংবা রেডিও শুনতে ব্যস্ত; আমি তখন সেই বইয়ের স্ট্যাপল খুলে পুরো বইটি পড়ে নেই। একটি ডায়েরির যে নাম দেওয়া যায় এই চিন্তাটি আমায় এতই অভিভূত করে যে, সে বছর থেকেই দিনলিপি লিখি এবং নিজের ডায়েরিটিকে ডাকতে শুরু করি একটি নির্দিষ্ট নামে।
এত বছর পর বর্তমানে আবার যখন এক নির্ঘুম, সুনসান মধ্যরাতে কিন্ডেলে বইটি নিয়ে পড়তে শুরু করি, তখন রীতিমত স্মৃতির দরজায় ধাক্কা মারতে থাকে শৈশব। এবং অল্পক্ষণের মাঝেই অ্যানার দৈনন্দিন জীবনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুরু করি বাস করতে। একটু থেমে, চিন্তা করা যায়, কী আছে অ্যানার ডায়েরিতে যা এত বছর পরে এসেও পাঠক-মনকে করে আন্দোলিত? কী তার ম্যাজিক কিংবা অস্ত্র? শব্দ, নিখুঁত বর্ণনা, ভাষার ব্যবহার, আবেগ নাকি তার বহতা জীবন? একটা গুপ্ত কুঠুরি যেখানে দিনের আলোতে জানালা খোলা তো দূরে থাকুক; পর্দা পর্যন্ত সরানো যায় না। মূল দরজা লুকিয়ে রাখা হয় বইয়ের আলমিরা দিয়ে। যেখানে জীবনযাত্রা এলিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ডের মতো নয় বরং অপরিবর্তিত, একঘেয়ে এবং প্রচণ্ড মানসিক চাপের। সেখানে কী এমন আছে যা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো সুরে সুরে টেনে নেয় সকল বয়সী পাঠককে?
অ্যানার সেই গুপ্ত জীবনের সাথে কারও সাধারণ জীবনের তো কোনো মিল পাওয়া যায় না। সেখানের দুঃখ, যন্ত্রণা, ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা, দুর্বিষহ প্রহর, দুঃস্বপ্নের চৌহদ্দিতে বন্দি জীবন তাহলে আমাদের কেন টানে? কারণ জানতে হলে তাকাতে হবে বেশ পেছনে,
‘দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়াং গার্ল’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যানা তার জন্মদিন জুনের ১২ তারিখ থেকে শুরু হয় তার ডায়েরি লেখার সূত্রপাত। অল্প কিছুদিনের মাঝেই সে উপলন্ধি করতে পারে, নিয়মিত এই লেখার চর্চাটুকুর অভিজ্ঞতা বেশ ভিন্ন। ডায়েরি লেখা শুরু করার মাত্র সপ্তাহখানেক পরেই সে লিখে-
” কাগজের রয়েছে মানুষের চেয়েও বেশি সহনশীলতা”
তার মনে হয় তার চমৎকার একটি পরিবার, গোটা ত্রিশেক বন্ধুবান্ধব, কিছু কিশোরের মুগ্ধ দৃষ্টি থাকার পরেও পৃথিবীতে সে বড্ড একা। মনে হয়, ‘কিটি’ নামের এই ডায়েরিই কেবল পারে তার প্রকৃত বন্ধু হতে। আর তাই চারপাশের প্রতিটি ঘটনা নিয়েই নিজস্ব অভিমত সে ব্যক্ত করতে শুরু করে কিটির কাছে। চিঠির মতো করে লেখা সেই ডায়েরিতে অ্যানাকে এমন একটি ফ্রেমে দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে সে বাস করছে এক স্বপ্নের ভুবনে, প্রতি শনিবার অপেক্ষা করছে নতুন বই পাওয়ার, যে ভালোবাসে ইতিহাস, গ্রীক ও রোমান মিথলজি আর নানান দেশের ভাষা। যে অবসরে শর্ট হ্যান্ড কিংবা নাচের চর্চা করে। শোনে মোৎজার্ট। যে মনে মনে ভাবে সে তার মায়ের মতো সরলরৈখিক জীবন কাটাতে পারবে না, সে চায় নিজস্ব পরিচয়। সে হতে চায় একজন লেখক কিংবা সাংবাদিক। তাই সে লেখে-
“ লোকে তোমাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলবেই, তার মানে এই নয় যে; তুমি নিজস্ব মতামত জানানো থামিয়ে দিবে। ”
তবে দিনের পর দিন গুপ্ত কুঠুরিতে থাকা অ্যানা এবং বাকি সকলের জন্য সহজ কিছু ছিল না। সারাক্ষণ ধরা পড়ে যাওয়ার আতংক। বাইরে যেতে না পারা, দিনের বেলা থেকে শুরু রাতের বেলা চলাচলের ওপর নানা সাবধানতা ও নিষেধাজ্ঞা, এসবের পাশাপাশি মা এবং বড় বোন মার্গটের সাথে নানা বিষয় নিয়ে মতানৈক্য, সব মিলিয়ে অ্যানার এই নিঃসঙ্গতা চিবুকের চেয়েও একা হবার চেয়ে কম কিছু ছিল না। বাড়ন্ত সময়ের চুপচাপ দুপুর কিংবা অলস হয়ে এলিয়ে থাকা গুপ্ত কুঠুরিতে, রেডিওতে শোনা একের পর দুঃসংবাদের হাত ধরে, অ্যানা বিপন্নতায় কাটাতে চায়নি তার দিনগুলো। তাই যে পাখির উড়তে মন চাইলে; খাঁচা কোনো বাঁধা হতে পারে না অমন কেউ হয়েই সে নিজের ভাবনার জগতে ডুবসাঁতার কাটতে থাকে অনবরত। নিজের হতাশা, একাকীত্ব, বিরক্তি, অস্থিরতা অনেক ক্ষেত্রে আত্মকেন্দ্রিকতা নিপুণভাবে তুলে ধরে লেখায়। সত্যি বলতে, ডায়েরিতে তার শব্দচয়ন ছিল অপকট ও শতভাগ সৎ। দৈনন্দিন রুটিন, পাঠ অভিজ্ঞতা, অংকের প্রতি অনীহা, যুদ্ধ, মানবতা, মিঃ ভ্যান ডান ও তার স্ত্রীর প্রতি বিরক্তি, বাবার প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, মায়ের প্রতি দূরত্ব থেকে শুরু করে সবই যে তুলে ধরেছিল বেশ পরিপক্বতার সাথে।
যেমন মিসেস ভ্যান ডানের সাথে খাবার টেবিলে সবজি কম এবং আলু বেশি নেওয়া নিয়ে অ্যানা ও তার মাঝে তর্ক শুরু হলে সে মনে মনে ভাবে, মিসেস ভ্যান ডান নিজের সন্তানের পাশাপাশি অন্যের সন্তানকেও মানুষ করতে পছন্দ করেন। কিংবা অ্যানা মায়ের সাথে দ্বন্দ্ব ও মতবিভেদ নিয়ে একসময় উপলব্ধি করে, তার মায়ের চেয়েও সে তার বন্ধুদেরকে বেশি বুঝতে পারে। এই অংশে এসে, পাঠক হিসেবে আমার মাঝেও একধরনের নস্টালজিয়া কাজ করে। মনে পড়ে, অ্যানার বয়সে, বয়ঃসন্ধির কালে একই ধরণের সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি এবং আমার সমবয়সী অনেকে। তখন মনে হতো; অভিভাবকরা ভালো কিছু করার নামে বারবার আমাদের কাছে দূর্বোধ্য হয়ে উঠতেন এবং তাদের চেয়ে বন্ধুদেরকেই আমরা অনেক বেশি বুঝতে পারতাম।
অ্যানার মার সাথে তার প্রায়শই লেগে থাকত নানাবিধ দ্বন্দ্ব। অ্যানার বোন মার্গট সবার চোখে একজন ভদ্র, নম্র, পড়ুয়া ও সুন্দরী মেয়ে হলেও অ্যানার জন্য সে ছিল দূরের তারা। যাকে দেখা যায় কিন্তু নিকটের কেউ ভাবা যায় না। প্রায় কাছাকাছি বয়সের হবার পরেও মার্গট কখনওই পারেনি ছোটবোনের বন্ধু হতে কিংবা তার জন্য এমন একটি মুক্ত জানালা হতে যেখানে এসে সে বুকভরে শ্বাস নিতে পারবে। তবে তার জীবনে উল্লেখযোগ্য চরিত্র ছিল বাবা অটো ফ্র্যাঙ্ক। ধারণা করা যায়, অ্যানা অন্যান্য মেয়েদের চেয়েও গভীরতর চিন্তার এবং আলোর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলার যে ক্ষমতা অর্জন করেছিল, এর বীজটুকু বোপন করেছিলেন অটো ফ্র্যাঙ্ক নিজেই। পেশায় ব্যবসায়ী হয়েও তিনি ছিলেন বেশ বই পড়ুয়া, ধ্রুপদী সঙ্গীতের পাঁড় ভক্ত, নিয়মিত খবর শোনা, দূর দৃষ্টিসম্পন্ন, মুক্তমনা, বিচক্ষণ এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ। অ্যানার বিশ্বাস ছিল একমাত্র তার বাবাই তাকে বুঝতে পারে। মায়ের দুর্ব্যবহার তাকে যেখানে অস্থির করে তুলতো কিন্তু মচকাতে পারত না, বাবার একটি গম্ভীর কথা সেখানে তার চোখে নিয়ে আসত অশ্রু। তার সাহস, উদ্দীপনা, এগিয়ে চলার দৃঢ় প্রেরণা ছিল তার বাবা। এসব ছাড়াও আরেকটি বিষয় ছিল, যা অ্যানার চিন্তা ও মানবতার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করেছে বলে আমার মনে হয়; তা হল, ইহুদি পরিবার হিসেবে অটো ফ্র্যাঙ্ক বা পরিবারের বাকি সদস্যদের মাঝে কোনো কিছু নিয়েই ধর্মান্ধতা দেখা যায়নি। বরং বিভিন্ন মানুষের সাথে সুসম্পর্কই দেখা গিয়েছে।
১৯৪৩ সালে এপ্রিলের এক রাতে অ্যানাকে তার বাবার বদলে মায়ের সাথে রাতের প্রার্থনা করতে বলা হলে; সে স্পষ্ট অস্বীকৃতি জানায়। যার ফলে, তার মা বেশ বেদনা আক্রান্ত হয়ে বলেন, তিনি অ্যানার ওপর রাগ করেননি। কারণ ভালোবাসা কখনোও জোর করে হয় না। এ কথা শুনে অ্যানা স্তব্ধ হয়ে থাকলেও প্রতিবাদ করে না, কারণ তার কাছে মনে হয়, সে মায়ের এই খারাপ লাগার অনুভূতির জন্য দুঃখবোধ করতে পারে কিন্তু এ কথাটি অস্বীকার করতে পারে না। যেহেতু কথাটি সত্য। অ্যানার বাবা তার কাছ থেকে এ বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা আশা করলেও; একই কারণে সে তা করতে পারে না। কারণ মিথ্যা কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে ভাবে-
“প্রত্যকেই প্রত্যাশা করেছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করব। তবে, এ ক্ষেত্রে আমি ক্ষমা চাইতে পারি না, কারণ আমি যা বলেছি সত্য বলেছি। কখনও না কখনও মা এই সত্যটি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারতেন। তাই, আমি কেবলই মায়ের জন্য দুঃখবোধ করতে পারি।”
এ কথা থেকে আমরা অ্যানার সৎ ও স্পষ্টবাদী চরিত্রের পাশাপাশি তার একগুঁয়ে আচরণের আভাসও পেয়ে যাই।
একটি বদ্ধঘরে কিংবা গুপ্তকুঠুরিতে দিনের পর দিন একই নিয়মে ইঁদুরের মতো লুকিয়ে জীবন যাপন করা সহজ কিছু নয়। এসব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর কমবেশি সকলেই হয়ে ওঠে নিহিলিস্ট, অসহিষ্ণু, আবেগি কিংবা নৈতিক সংকটে ভুক্তভোগী। অ্যানার পরিবারের সাথে ভ্যান ডানের পরিবারের সম্পর্কও তেমনই হয়েছিল। ঝগড়া, মতভেদ, তর্ক লেগেই থাকত যা অ্যানার মানসিক জগতে নিয়ে আসত তুমুল অন্ধকার। এদিকে কমন ডাইনিংয়ের টেবিল ক্লথে পড়েছে তেলের আস্তরণ, বিছানার ফ্লানেলের চাদরেরর ময়লা, বাবার নিষ্প্রভ ট্রাউজার, মায়ের করসেটের ফেঁসে যাওয়া, কিংবা মার্গটের দুই সাইজের ছোট ব্রা পরার বর্ণনার কৌশলের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি বছর পেরিয়ে আসা এই পরিবারগুলোর জীবন প্রবাহ কতটা অনিশ্চয়তা ও মলিনতায় জর্জরিত হয়ে আছে।
এসবের পাশাপাশি যখন তখন পানির কল না খোলা, কাপড় না কাঁচা, গোসল না করা, রাত সাড়ে আটটার মাঝে সকল কাজ শেষ করে ফেলা, ফ্লু হলে কম্বলের একদম গভীরে গিয়ে কাশি দেওয়া, এবং প্রয়োজনে টয়লেটে পর্যন্ত না যাওয়ার মতো যন্ত্রণাদায়ক বিধিনিষেধ তো ছিলই।
গুপ্ত কুঠুরিতে অ্যানাদের রোজকার রুটিনের অংশ ছিল একসাথে রেডিও শোনা। লন্ডন থেকে প্রচারিত হওয়া এই খবরগুলো তাদেরকে বাইরেরই পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিতো। অ্যানাও বেশ সচেতনভাবে খোঁজ নিতো মিত্রবাহিনী কী করছে, বিশেষ করে ইতালি ও রাশিয়ার যুদ্ধের সর্বশেষ অগ্রগতি কী?
অ্যানাকে আলোড়িত করছিল আমস্টারডামের নানা খবরাখবরও। ১৯৪৩ সালের মাঝামঝি গোলাবর্ষনের কারণে নিহত হয়েছিল প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছিল অগণিত। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে একের পর এক লাশ বের করতে হয়েছে। অজস্র শিশুরা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে আর, তাদের পরিবারের কাউকে জীবিত দেখতে পায়নি। অ্যানা এসব জেনে দুঃখ পেয়েছিল। একমাত্র ডায়েরিতে লিখে যাওয়া ছাড়া; নিজেকে নির্ভার করার আর কোনো পন্থা তার ছিল না। তবে এমন সব ওলটপালট হয়ে যাওয়া; বিহ্বল দিনের পরেও পাতা উলটে আমরা জানতে পারি, একটা পর্যায়ে গুপ্ত কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা সকলেই একদিন আলোচনা করছে গৃহবন্দির সময় শেষ হলে তারা কে কী করবে। মানুষ সম্ভবত খুব দীর্ঘ সময় আশাহীন হয়ে থাকতে পারে না। অ্যানার আশাবাদী আচরণ কিংবা বেঁচে থাকার উইশফুল থিংকিং কারণেই হোক; অমন বিপর্যস্ত সময়েও গুপ্ত কুঠুরিতে আটকে থাকা আটজন সদস্য আলো খুঁজে, সুন্দর ভবিষ্যতের একটা আবছা প্রদীপ তুলে ধরতে চায় পরস্পরের কাছে।
১৯৪৩ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে বিখ্যাত জার্মান লেখক ও কবি গ্যোটের একটি উক্তি লিখে অ্যানা জানায়, সে একইসাথে সুখের সর্বোচ্চ শিখরে এবং দুঃখের গভীর সাগরে আছে। একদিকে সে যদি নিজেকে অন্যান্য ইহুদি ছেলেমেয়েদের দূর্দশার সাথে তুলনা করে; তাহলে যেমন তার নিজেকে বেশ ভাগ্যবতী মনে হয়, অন্যদিকে বাইরের স্বাভাবিক জীবন থেকে সে বঞ্চিত আছে ভেবে, তার নিজের জন্য বিষাদ কাজ করে। বড়দিনের উৎসবমুখর সময়গুলোতে যেখানে সারা শহর লাল-সবুজ রঙে সেজে ওঠে, তখন একই বাসায় দীর্ঘদিন লুকিয়ে বাস করতে করতে অ্যানার মনে হয়, সুদিনের অপেক্ষা যেন এক অনন্ত যাত্রার নাম। যখনই সাহায্যকারীদের কেউ কেউ বাইরে থেকে আসত; আর এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে বয়ে যেত; সে প্রতিবারই ভাবত, আবার কবে ছুটে বাইরে গিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারবে? আবার সে নিজেই বলতো,
“ যেখানে আশা আছে, সেখানেই আছে জীবন। যা আমাদের সতেজ সাহসে পূর্ণ করে এবং আমাদের আবার করে তোলে শক্তিশালী।”
১৯৪৪ সালে জানুয়ারি মাসের প্রথম রবিবারে, অবসর সময়ে অ্যানা তার আগের বছরের লেখাগুলোর পাতা উলটাতে থাকে। এবং মায়ের সম্পর্কে অতীত ভাবনা ও প্রতিক্রিয়াগুলো তাকে করে তুলে লজ্জিত ও স্তম্ভিত। সে অনুতপ্ত হয় এবং তার মনে হয় সে নিজের পুরাতন সত্ত্বাকে চিনতে পারছে না। মনে হয়, সে কেন শুধু নিজেকেই দেখেছে, অন্যদের নিয়ে ভাবেনি। অন্যের চশমা নিজের চোখে এঁটে কেন সে তাকায়নি চারপাশে। তার এই আত্মউপলব্ধির পরিবর্তনটুকু এত চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয় যে, পাঠক বুঝতে পারবে অ্যানা কিশোরীবেলা থেকে পদার্পণ করেছে নারী হবার পথে। মাত্র তিন মাস আগে পিরিয়ড শুরু হওয়ার এই চক্র শুধু অ্যানার মাঝে শারীরিক নয় বিকাশ ঘটাতে থাকে মানসিকভাবেও। এবং সে এই নতুন পরিবর্তনটুকুও গ্রহণ করে নেয় অসম্ভব ইতিবাচকতার সাথে। তার মনে হয় এটা নিছক উৎপাত নয় বরং এক অদ্ভুত রহস্যও বটে। সে অতীতের সব ভুল মিটিয়ে ফেলতে চায়, আবার এটাও বুঝতে পারে এ এত সহজ কোনো অংক নয়। অ্যানার বহুমুখী প্রতিভার পাশাপাশি ছিল তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষন ক্ষমতা। অ্যানার মা কাউকে উৎসাহ দিতে হলে নানা দুঃখ-দূর্দশার উদাহরণ দিয়ে বলতেন, কৃতজ্ঞ হও যে তোমায় এমন কিছু দেখতে হচ্ছে না। অথচ অ্যানার মনে হতো, উৎসাহ দিতে হবে আনন্দের সাথে। যে সৌন্দর্য আছে নিসর্গে, রোদের আলো কিংবা স্বাধীনতায়, তা দেখে আর আত্মস্থ করেই মানুষ হতে পারবে সুখী। কারণ যে নিজে সুখী সেই একমাত্র পারে অন্যদেরকেও সুখী করতে।
এদিকে নতুন বছরে অ্যানার কাছে হঠাৎ বহমান স্রোতের মতো যেন প্রেম নিয়ে আসে দেবী আফ্রোদিতি। কারও সাথে কথা বলার এবং গভীর আলাপের বাসনায় ব্যাকুল হয় সে। তার থেকে থেকে কেবলই মনে হয় পিটারের কথা। পিটার, যার বাতিক ক্রসওয়ার্ড পাজল সমাধান করা, যে পছন্দ করে ঝামেলামুক্ত হয়ে নিজের মতো থাকতে। ক্রমেই অ্যানার চোখে সে হয়ে ওঠে পৃথিবীর সুন্দরতম পুরুষ। এমনকি সে একদিন স্বপ্ন দেখে পিটার তার সাথে মুখোমুখি বসে দেখছে ম্যারি বসের আঁকা একটি ছবি। সে হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করতে পারে, পিটারকে ভাবতে ভাবতে এই পৃথিবীর সকল কিছু তার প্রচণ্ড সুন্দর মনে হচ্ছে।
অ্যানার জ্ঞান পিপাসু, উচ্চাকাঙ্ক্ষী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি; তারমাঝে জন্ম নেয় রোমান্টিকতা। যার ফলে, এর আগে পুরো ডায়েরিতেই কমবেশি আবছা হয়ে থাকা পিটারের চরিত্র; ধীরে ধীরে পাঠকের কাছে জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠতে থাকে। অ্যানা আর পিটার কথা বলতে শুরু করে একে অন্যের চোখ দিয়ে, পরস্পরের কাছে আসে নিবিড়ভাবে। আমরা দেখতে পাই দমবন্ধ হয়ে যাওয়া বাক্সবন্দি জীবনে; জানালাগুলো বন্ধ থাকার পরেও কোথা থাকে যেন ফুরফুরে হাওয়া বইছে। মাথার ওপরে ঝকঝক করছে রোদ, অ্যানার উৎকর্ণতা ছুঁয়ে যায় আমাদের, তার অপেক্ষা হয়ে ওঠে আমাদের অপেক্ষা। প্রথম প্রেম কিংবা প্রিয় কবিতার মতো আমরাও অনুভব করতে থাকি ওর আনন্দ। উড়তে থাকি তার সাথে কাগুজে এরোপ্লেন হয়ে।
রূপান্তরিত হয়ে ওঠা অ্যানার ভেতরে আলোড়ন ঘটাতে থাকে; একই সাথে অনেক অনুভূতি, তার প্রয়োজন হয় একান্ত নিজস্ব একটি স্থানের। নিজের সাথে সে চায় সময় কাটাতে, মুখোমুখি বসতে। দ্বিধা ও অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে। অবশেষে বহু চেষ্টার পর, মিঃ ডুসেলের সাথে মৌখিক চুক্তি হয়, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সে পাবে নিজের ঘরে কিছু সময় থাকার অনুমতি।
মার্চ মাসের এক রবিবার ৩৫০ টি ব্রিটিশ প্লেন এসে ইমুইডেনের ওপর পাঁচ লক্ষ কিলো ওজনের বোমাবর্ষণ করে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির কারণে বেড়ে যায় মহামারীর প্রাদুর্ভাব, অভাব-অনটন। জিনিসপত্র কেনার দীর্ঘ লাইন লাগে, বৃদ্ধি পায় খুন, চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ। পণ্যের দাম বাড়তে থাকে, লাপাতা হতে থাকে অল্প বয়সী মেয়েরা, চিকিৎসকরা রোগী দেখতে যেতে পারে না, কারণ গাড়ি রেখে গেলেই কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে। বাড়িঘরের জানালার কাচ ভেঙ্গে যে যা পারছে হাতিয়ে নিতে থাকে, লাইন কেটে দেয় পাবলিক ফোনবুথের, রাতারাতি ছড়াতে থাকে অরাজকতা। এসব বাদে, নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে খাবার সরবারহ করা বেশ কিছু মানুষ। এরপর ধরা পড়ে অ্যানাদের পরিচিত সবজি বিক্রেতা। ফলে অনেকটা নষ্ট হয়ে আসা সবজি, একই ধরণের সীমিত খাবার খেয়ে থাকা, তিনবেলার বদলে দু’বেলা খাবার খেতে অভ্যস্থ হবার চেষ্টা চালিয়ে যায় গুপ্ত কুঠুরির মানুষগুলো।
তবে এটুকুতেই নেই পরিত্রাণ, একরাতে চোরের দল হানা দিলে আতংকিত হয়ে পড়ে বাড়ির প্রতিটি সদস্য। চোরদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া গেলেও, প্রতিবেশীদের কেউ পুলিশের কাছে ধরা পড়িয়ে দিতে পারে এই আশংকা জর্জরিত হয় সবাই। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় ও ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে সকলে। নিঃশব্দে আত্মগোপন করে থাকে একটি স্থানে। নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ বাদে কারও মুখে আর কোনো শব্দ নেই। গাঢ় অন্ধকার কেন কুড়ে কুড়ে গিলে খেতে থাকে প্রত্যেককে। কল ছাড়ার কিংবা টয়লেটের শব্দ এড়াতে একটি বালতির মধ্যে তারা মলত্যাগ করে জমা করতে থাকে। পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যবহার করে পিটারের পরিত্যক্ত ছেঁড়া কাগজ। মলের তীব্র ও কটু গন্ধ ছড়াতে থাকে চারপাশে। এরইমাঝে মেঝেতে শুয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনক্রমে রাত পার করার চেষ্টা করতে থাকে সকলে। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিবরণ পড়তে পড়তে পাঠকের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। বেঁচে থাকার জন্য বুভুক্ষু এবং ধরা না পরার আকুলতায় লুকিয়ে থাকা মানুষগুলোকে মনে হবে বরশীতে আটকে থাকা মাছদের মতো। যারা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে।
তবে আশার কথা; গুহার ভেতরে লুকিয়ে থাকা একটা জীবনে থেকেও অ্যানা অপেক্ষা করতো আলোর বিস্ফোরণের। দৃশ্যমান জগতের বাইরের জগতটাকে দেখতে চাইতো নিরপেক্ষভাবে। শুধুমাত্র ইহুদি হয়ে জন্ম নিয়েছে বলে; যে অবর্ণনীয় হেনস্তার সম্মুখীন তাদের হতে হয়েছিল এ অন্যায় সে মেনে নিতে পারত না। সে ভাবত কেন একজন খ্রিস্টান কিছু করলে তার জন্য সে নিজেই দায়ী, কিন্তু একজন ইহুদি কিছু করলে তার জন্য দায় পড়বে সকল ইহুদীদের ওপর, এই অবিচার তাকে হতাশাগ্রস্থ ও দুঃখী করে ফেলত। সে ভাবতো,
” কী চমৎকার হতো, যদি কাউকে উন্নত ও নির্মল পৃথিবী শুরু করার জন্য একটি মুহূর্তের অপেক্ষাও না করতে হতো।”
এবং এতকিছুর পরেও সে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাতে পারেনি, তাই ডায়েরিতে লিখেছিল,
“সবকিছু সত্ত্বেও, আমি এখনও বিশ্বাস করি মানুষ প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ের দিক থেকে সত্যিই ভালো”
পনের বছরে পা দিয়ে অ্যানা আবারও হয়ে ওঠে আশাবাদী। সুনীল আকাশ, চাঁদের আলো, ফুল-পাখিদের নিয়ে ভাবে। একা একা চাঁদ দেখবে বলে রাত জাগে। সে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায়। কোনরকমের পক্ষপাত ছাড়াই সে হয়ে ওঠে আরও আত্মসচেতন। এবং ক্রমশ বুঝতে পারে তার আছে দৈত্বসত্তা। সে শুধুই সাদা কিংবা কালো ধাঁচে ফেলার মতো সহজ নয়। নিজের আত্মবিকাশের সাথে সাথে সে শুনতে পায় অজস্র মানুষের আর্তনাদ, যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা। সে চায় সকল নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটিয়ে মানবতার জয় আসুক। পৃথিবীতে আসুক শান্তি, সমতা ও সুস্থিরতা।
তবে, মানুষের জীবন কোন লিনিয়ার রেখা নয় কিংবা জীবন মানেই রূপকথার হ্যাপি এন্ডিং না। তাই উপন্যাসের সুখী সময়ের দিনগুলোর মতো কোনো আলোকিত মুক্তির স্বাদ অ্যানার ভাগ্যে আসে না। প্রায় ছাব্বিশ মাসের ক্লান্তিকর, অনিশ্চিত যাত্রার পর ১৯৪৪ সালে আগস্টের ৪ তারিখে, আনুমানিক সকাল সাড়ে দশটার দিকে গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পেয়ে, নাৎসি বাহিনীর কাছে ধরা পরে গুপ্ত কুঠুরির সকল সদস্য। সেখান থেকে তাদের প্রেরণ করা হয় দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসের ওয়েস্টব্রোকে। এরপর পোল্যান্ডের অসইউজে। অ্যানার বাবা অটো ফ্র্যাঙ্ক বাদে, গুপ্ত কুঠুরির আটজন সদস্যদের কেউ জীবিত হয়ে ফিরে আসতে পারেনি। ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে, অ্যানার বোন মাগর্ট ও অ্যানা বের্গেন-রেলসেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নির্মম-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে টাইফাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
১৯৪৪ সালের ১ আগস্টের পর অ্যানা আর ডায়েরিতে কিছু লিখতে পারেনি। পরিবারের সকলকে হারিয়ে, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা বিধ্বস্ত ও শ্রান্ত অটো ফ্রাঙ্ক পারিবারিক বন্ধু ও সেক্রেটারি মিয়েপের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারেন অ্যানার মূল ডায়েরিসহ আরও চারটি নোটবুক ও প্রায় ৩০০-র অধিক কাগজ। ১৯৪৭ সালে প্রথমবারের মতো বই আকারে ডাচ ভাষায় প্রকাশিত হয় অ্যানার ডায়েরি ‘রিয়ার অ্যানেক্স‘ নামে।
প্রশ্ন থাকতে পারে অবরুদ্ধ জীবনে অ্যানা কি তবে আবদ্ধই থেকে গেলো? নাকি মুক্তি পেলো? পাঠক হিসেবে ডায়েরিটি পড়তে পড়তে সমাপ্তিতে এসে যখন কিন্ডেল জানায় টু মিনিটস লেফট ইন বুক তখন, একের পর এক মৃত্যুর খবর পড়তে থাকি। অ্যানার মা, মিঃ এবং মিসেস ভ্যান ডান, পিটার, মার্গট ও অ্যানার মৃত্যুর তথ্যগুলো আমাদের হৃদয়ের কোথায় যেন বিষাদ ছড়াতে থাকে। এই পরিণতি বহু আগে থেকে জানা থাকার পরেও কিন্ডেলের সাদাকালো পাতা কিছুটা ঝাপসা করে তোলে। মোচড় তোলে মনের অভ্যন্তরে। গুগল ইমেজে পাওয়া কাঁধ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুল, কৌতূহলী ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, চিরচেনা চেয়ারে বসে ডায়েরি লেখার ভঙ্গিতে তোলা ছবিতে; মৃত অ্যানাকে আমাদের চোখে যেন আরও পরিচিত ও প্রাণবন্ত করে তোলে। আমরা বুঝতে পারি, অ্যানার অবরুদ্ধ জীবনের মুক্তি ঘটেছে আরও বিস্তৃত ক্যানভাসে, আলোয় আলোয়। ধরা পড়ার পর অ্যানার মৃত্যু যেন আগে থেকে নির্ধারিতই ছিল। তারপরেও এটাই চিরন্তন সত্য; অ্যানার দেহটিকে আটকে ফেলতে পারলেও, প্রকৃত অ্যানাকে ধরার সাধ্য কোনো হিটলার ও নাৎসিবাহিনীর ছিল না। আর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে অন্যতম সেরা পণ্ডিত আল বেরুনীর বলে যাওয়া উক্তির মতো অ্যানা সত্য ও সতত হয়ে ওঠে আমাদের কাছে, জীবন দীর্ঘ নয়, বিস্তৃত হওয়া হওয়া চাই। পনের বছরের সীমিত জীবনে অ্যানা যেমন দুর্দান্ত করে বেঁচেছে অনেকে একশ বছর বেঁচেও, তা হয়তো ছুঁতে পারবে না। অ্যানা যেন ফিনিক্স পাখির মতো, বারবার বেঁচে ওঠে সারা পৃথিবীর সকল পাঠকের মাঝে, মানবতার মাঝে। আশা জাগিয়ে যায়, স্বপ্ন দেখায় সবখানে। তাই তো, দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি সম্পর্কে বলেছিলেন,
“রোবেন দ্বীপে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়ত। বইটি একই সঙ্গে আমাদের যেমন উৎসাহ দিয়েছে, উদ্দীপনা জাগিয়ে রেখেছে, ঠিক সেভাবেই আমাদের শক্তি দিয়েছে এটা বিশ্বাস করতে, স্বাধীনতা আসবেই।”
নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, এক্সবক্স, চেক-ইন ও প্রযুক্তির দ্রুততম দুনিয়ায় এতকিছু থাকার পরেও আজও গিয়ার ভিয়ারের ছোট্ট ভিডিও ক্লিপে, অ্যানার স্মরণে করা মিউজিয়াম থেকে শুরু করে ফেসবুক পেইজে, বইয়ের পাতায়, কোটেশনে সর্বত্র আমরা খুঁজে পাই অ্যানার ছাপ। উপলব্ধি করতে পারি মৃত্যুর প্রায় ৭৬ বছর পরও এই পৃথিবীতে আনা ফ্রাঙ্ক কী আশ্চর্য প্রাসঙ্গিক! এখনও গল্প, উপন্যাস নিয়ে কাজ করা, ত্রিশ পেরিয়ে আসা এক পাঠক দ্বিতীয়বারের মতো অ্যানার লেখা পড়তে পড়তে নিজের ডায়েরিতে নোট নিতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে ভাবে, এমন কীভাবে সম্ভব যে বারো বছর বয়সের পাঠ অভিজ্ঞতা যে অনুভূতি এনে দেয়, সেই একই ধরণের কিন্তু আর প্রবল অনুভূতি আবার পাওয়া যায়, বইটি দ্বিতীয়বার পড়তে গেলে!
কবি ও ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি তাঁর লেখায় একদা বলেছিলেন,
“ধর্মের মুল উদ্দেশ্য একজন মানুষকে স্বর্গে প্রবেশ করানো নয় বরং মানুষটির অন্তরে স্বর্গ সৃষ্টি করা।”
টমাস যা লিখে গিয়েছেন তারই বাস্তব উপলব্ধি আমরা খুঁজে পাই একজন অ্যানার নাতিদীর্ঘ অথচ অমর হয়ে থাকা জীবনে। এবং অনুভব করতে পারি শব্দের এবং লেখনীর কী প্রচণ্ড ক্ষমতা, যা আমাদের পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বারবার ফিরিয়ে আনে একটি লাল-সাদা চেকের ডায়েরির কাছে। নতুন করে বেঁচে ওঠার জন্য।