Blog

আমার বন্ধু, এক বছর আগে ধীরে ধীরে আঁধার নেমে আসা সন্ধ্যায় হুট করেই আমাদের জানালো, সে ফিরে যাচ্ছে কলকাতায়। আমেরিকা ছেড়ে। আচমকা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার মতোই আমরা তখন চুপ করে ছিলাম। ও চলে যাবে, তার মানে শুরু হবে ওর নতুন অধ্যায়। নতুন যাত্রা। আরেক জীবন। সেখানে এই দেশ নেই, শহর নেই, আবহাওয়া নেই, ঘর নেই… সবচেয়ে বড় কথা আমরাও নেই।

বুধবার রাতগুলোতে আমরা সিনেমা দেখতাম। গরম নেমে আসা দিনে মাছ ধরতাম। দামী কনভ্যার্টিবল গাড়ি না বরং স্টেট পার্কের পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে কিছু দার্শনিক কথা-বার্তা বলতে পারলে মনে হতো,

‘কেন এমন ভালো লাগছে এই বেঁচে থাকা?’

আরক্যানসাসে ট্রেকিং করতে গিয়ে এক সরু গুহার ভেতর ঢুকেছিলাম আমরা। পায়ের নিচে অল্প পানি, মাথায় ওপর চেপে আসা গুহার স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল। মৃদু আঁশটে ঘ্রাণ ছড়ানো পাথর ধরে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে সেই গুহা পার হয়ে আমরা দেখতে গেলাম একটা উত্তাল ঝর্ণা। টর্চের অল্প আলোতে দম বন্ধ করা অনুভূতি বুকের ওপর হামলে পড়ছিল। পিঠের ব্যাকপ্যাক, মোবাইল, টর্চ, সব সামলে, অন্ধকারে ডুবে যাওয়া চারপেয়ে প্রাণীর মতো আমরা তাও আগাচ্ছিলাম। একটা সময় ক্লান্তি চেপে ধরেছিল। মনে হচ্ছিল জীবন চলে গেলেও পথ শেষ হবে না। বন্ধুটি তখন এগিয়ে গিয়েছে বেশ। পিছু ফিরে বলেছিল,

‘আর কিছুক্ষণ। এই পথ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে…’

ওর চলে যাবার খবর শুনে আমার সেদিন মনে হচ্ছিল, ও যেন একই কথাই বলছে।

ভিন্ন দেশ, ভিন্ন শহর, ভিন্ন সময় মিলিয়ে এখন আমাদের দৈনন্দিন রুটিন একদম আলাদা। সে কলকাতা থেকে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছে ব্যাঙ্গালোর। মাঝে মধ্যে দু একবার কথা হলেও এসেছে যোগাযোগহীনতা। সেও ব্যস্ত আর আমিও। তবে এখনও যখন ওর পুরানো ফ্ল্যাটের পাশ দিয়ে আমরা ড্রাইভ করে চলে যাই, তখন অজান্তেই তাকানো হয় বিল্ডিংটার দিকে। এখানে একদিন ও ছিল, ওকে বাড়ি পর্যন্ত রাইড দিতে আমরা নিয়মিত আসতাম, এই পথ-এই বাঁক এক সময় কতই না চেনা ছিল! এখন আর কিছুই নেই। তবুও স্মৃতি কিংবা অভ্যাসের টানে চোখ চলে যায়।
গত একটা বছরে পুরো পৃথিবী এমন করে বদলে গেছে যে পেছনে তাকালে বিশ্বাস হয় না, ফেলে আসা সময়ে ওটা আমিই ছিলাম। ও ছিল। ওরা ছিল। আমরা ছিলাম। এইসব স্মৃতি এখন ফুলে নোয়ানো ছায়াডাল- মাঝে মাঝে নুয়ে আসে মনের কাছে। আবার চলে যায়। আমি জানি, খুব ইচ্ছে করলেও আমার ঘরের লেখার টেবিলে বসে ব্যাঙ্গালোরের আবহাওয়া আমি কখনওই টের পাব না। এটাও জানব না; সমস্ত দিনের শেষে আমার বন্ধু যখন ক্লান্ত হয়ে তার বোনদের কাছে ফিরে আসে, তখন আসলে তার আগের জীবনের কথা মনে পড়ে কিনা! জানব না, এই সামারে তার পরিকল্পনা কী! আগে তো বেশ ঘুরতে যেত। তবে কলকাতার বিষ্ণুপুরের পর ব্যাঙ্গালোরকে আমার এখন বেশ চেনা লাগে। আমি জানি, মেট্রোরেলে করে ৪৫ মিনিটের একটা একঘেয়ে জার্নিতে আমার বন্ধুটি হাঁসফাঁস করে। ইউরোপ, আমেরিকা দাপিয়ে এসে ব্যাঙ্গালোরের যে সুপরিচিত কোম্পানিতে সে কাজ করে, জায়গাটা তার জন্য বড় যন্ত্রণার। এর বাইরে আমি বহু কিছুই আর জানি না। আমারও জিজ্ঞেস করা হয় না।

তবে বছর ঘুরে একই সময় চলে আসার কারণেই হোক, বা মাঝে দীর্ঘদিন যোগাযোগহীনতার কারণেই হোক এবার যেন সে ফোন করে আরেকটু চঞ্চল হয়েই। তারপর, ‘কাফকায়েস্ক লাইফ’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। জানতে পারি, যে বইয়ের তালিকা আমি তাকে বছরখানেক আগে দিয়েছিলাম, তা সে এখন পড়া শুরু করেছে। লিটল প্রিন্স, অ্যানা ফ্র্যাংক, কাফকার মেটামরফোসিসসহ বেশ কিছু বই একে একে শেষ করে বর্তমানে তার হাতে এসেছে মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশ বছর। এই বইগুলোর ডিজিটাল পাতা বদল করতে গেলে প্রায়ই নাকি তার আমাদের লাইব্রেরি ঘোরার দিনগুলো মনে পড়ে যায়।

সব শুনে আমি সন্তর্পণে একটা নিঃশ্বাস ফেলি। আমাদের প্রায় বছরখানেক হলো দেখা নেই, ভিডিওকলে কথা হয়েছিল সেই ঈদের সময়। এরই মাঝে ফাঁদ পেতেছে কত পরিবর্তন, কত টানাপোড়েন, ঋতুবদল আর স্তব্ধ পুকুর। কিন্তু মেট্রো রেলের সেই ৪৫ মিনিট বই পড়ার দৃশ্যটুকুই শুধু যেন আমি এত হাজার মাইল দূর থেকেও দেখতে পাই স্পষ্ট। এই দু-একটা বই, হুট করে আসা চিঠির মতো হোয়াটসঅ্যাপে টুকরো মেসেজ, ভীষণ নাড়া দিয়ে যাওয়া কোন সিনেমা নাম, এটুকু কাচিয়ে কুচিয়ে আমরা আমাদের মনে করি এই চাঁদহীন রাতের সময়ে। ফোনে কথা বলার সময় ওর জন্য একটি বই পড়ুয়া মেয়ের সন্ধান পাওয়া নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেব বলে হাসাহাসি চলে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের নারী থেকে, আন্না কারেনিনা, এটনমেন্টের সিসিলিয়া, দ্য বাদারস ব্লুমের পেনালোপে কিংবা অ্যান ই উইথ এন ই-এর কথা বলে যাই। অযথা টুকরো আলাপ, যেন ঝাকড়া মাথাওয়ালা গাছ থেকে অকারণে টুপটাপ পাতা ঝরছে স্মৃতিচারণের। এরপর একসময় কথা ফুরায়। ফিরে আসি আগের দিনলিপিতে। যুক্তি মোড়ানো বাস্তবতা নিয়ে।

লিও তলস্তয় বহু আগেই বলে গিয়েছেন, ধৈর্য্য ও সময় সবকিছু বদলে দেয়। আমারও আজকাল তাই মনে হয়। আড়মোড়া ভেঙে উঠে; জীবনকে মন দিয়ে দেখার একটা ভিন্ন উপলব্ধি আছে। একলা বুক মেলে নিঃশব্দে সেদিকে তাকালে, জমাট অন্ধকার ছাড়াও কোথাও যেন একটা অতল, সুরময় গদ্য খুঁজে পাওয়া যায়…

লেখাটি নিয়ে মন্তব্য প্রদান করুন।

Your email address will not be published. Required fields are marked *