সিনেমা হলের পর্দায় বা নিয়মিত ছুটে যাওয়া ছবিঘরের স্টুডিওতে নয়, টঙ ঘর টকিজের তথ্যচিত্র ‘লিমিট’ দেখা হয়ে গেলো ইউটিউব থেকে।
জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল কিংবা কোনো নিখুঁত ফটোগ্রাফারের ভিউ ফাইন্ডারের বার্ডস আই ভিউ না, বরং দূর থেকে ঝাপসা হয়ে থাকা অবরুদ্ধ নাগরিক জীবন হঠাৎ ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরতে থাকে ফিল্মে। বহুতল ভবন, লাল ইটের দেয়াল, থরে থরে সাজানো ফ্ল্যাটবাড়ি, অসংখ্য জানালা, খোলা বারান্দা, রাজপথের গোটা কয়েক গাড়ি লংশট থেকে ক্লোজআপ শটে আমাদের চোখের ভেতর করতে থাকে আনাগোনা। নিউজ চ্যানেলের দামামা পেরিয়ে কিছু অচেনা কণ্ঠ বলে যায় ছোট ছোট গল্প। কেউ বলে বাজারে গিয়ে হুলুস্থুল কেনাকাটার অভিজ্ঞতা, কেউ বা বলে নিজের বাবা-মাকে ছুটির দিনগুলোতে দেখতে না পাওয়ার বেদনা, নিয়মিত নাগরিক জীবনের ছন্দপতনের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া এখন অসম্ভব বলে ভাবে আরেকজন, চিকিৎসক দম্পতি জানায় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে সন্তান ও বৃদ্ধা মায়ের কাছে যেতে না পারার আকুতি, কেউ আবার ভীষণ ইতিবাচভাবে ব্যক্ত করে, পেশাগত প্রচণ্ড ব্যস্ততা পেরিয়ে মা হিসেবে সময় দিতে পারছে নিজের সন্তানদের। ছেলের সাথে খেলছে ক্রিকেট। আচমকা ছুটে আসা দ্রুতগতির বলটিকে ধরতে শিখেছে আত্মবিশ্বাসের সাথে। কারও আবার শিল্পের জগতে ডুব মেরে কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলো যাচ্ছে অন্যরকম ব্যস্ততায়। নিরাপত্তাকর্মী, চিকিৎসক, মনোবিদ, ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক, চাকুরীজীবী থেকে শুরু করে সকলেই সতের মিনিট বারো সেকেন্ডের শব্দজটে তুলে ধরে নিজ নিজ অবস্থান।
‘মহামারী’ এ শব্দটি যেন প্রতি শতকে নতুন করে মানব সভ্যতাকে একটি সীমাবদ্ধতা ও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে এসেছে। সাবধানী ঘাতকের মতো আসা এশিয়ান ফ্লু, এইডস, বার্ড ফ্লু, কলেরা, প্লেগ এবং কভিড-১৯ প্রতিবার শক্তমুখে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে লিমিটেড ব্র্যাকেটের নিয়মাবলী। ওটুকুর মাঝেই হবে বাঁচতে। অভ্যস্থ হতে হবে গল্প, উপন্যাস কিংবা তথ্যচিত্র থেকে জেনে আসা দুঃস্বপ্নে। যে দুঃস্বপ্নের কথা বারবার উঠে এসেছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে হালের মার্গারেট অ্যাটউডের লেখায়। আর রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ, নিমতলির গনগনে আগুন আর এনায়েত বাজারের হেলে পড়া ভবনে কোনক্রমে ঠেস দিয়ে বাঁচার আকুতি আকাশে ছুঁড়ে গিয়েছে সাধারণ মানুষ। দুর্যোগ ও সংকটের যে আন্তঃসম্পর্ক তা ভেঙ্গে ফেলা হয়তো আমাদের জন্য দুরূহ। ভাবনার জগতে যুদ্ধ করতে থাকাটাই অবিরাম বাস্তবতা। যেখানে বাণিজ্যিক সিনেমার ঢঙে বেড়ে যেতে থাকে পণ্যের দাম, ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ ও মানবতার রক্ষার বর্ম হয় মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার। সেখানে দীর্ঘদিনের বদভ্যাসের মতো চুরি হতে থাকে নৈতিকতা আর সরকারি সাহায্য। আর চতুষ্কোণ স্ক্রিন থেকে তখন মা বলে ওঠেন, “বাড়ি আয় খোকা। মরলে একসাথে মরবো।” পাশাপাশি প্রচলিত বিধির অমান্যতা, যুক্তি আর আবেগের মিলেশ, অস্থিতিশীল, অনিশ্চিত জীবনের বর্ণনা চলতে থাকে অবিরত। তবুও কেন যেন কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। প্রাথমিকভাবে লক ডাউন, কোয়ারেন্টাইন শব্দগুলোকে অপ্রত্যাশিত ছুটির অপর নাম মনে হলেও ক্রমশ ভোল পাল্টে যায় দৈনন্দিন জীবনের।
দর্শক হিসেবে প্রথম নজরে গতিময় সময়ে ‘লিমিট’ নামের শর্টফিল্মের ব্যাপ্তিটুকু বেশ দীর্ঘ মনে হয়। তবে পরিচালক দেবাশিষ মজুমদার যখন কোনো কড়া চ্যালেঞ্জ তুলে নেওয়ার মতো গল্প বলার সাথে অজস্র বিচ্ছিন্ন অথচ রিফ্রেশিং ড্রোনশটে বন্দরনগরীর পার্থিক-অপার্থিব সৌন্দর্য তুলে ধরতে থাকেন, তখন মনে হয় তার গল্প উপস্থাপনের ফ্রেমটুকু বেশ নির্ভেজাল। নিউ মার্কেট মোড়, চেরাগী পাহাড়, কাজীর দেউরী, টাইগার পাস মোড় পেরিয়ে কর্ণফুলি ব্রীজ পর্যন্ত শুধু সৌন্দর্য অবলোকন করে যেতে হয়। শর্টফিল্মে নেই কোনো মানুষের অবয়ব, অথচ আকাশে উড়ে যায় পাখি, নদীতে স্থির নৌকা, নীল রঙের পানির ট্যাংকি, গাঢ় সবুজ গাছের ছায়াময়তা, একাকী রেললাইন বিন্দু বিন্দু দৃশ্যকল্পের কোলাজ সৃষ্টি করতে থাকে।
কভিড-১৯ এর কারণে পুরো পৃথিবী যে সীমাবদ্ধতা অনুভব করছে তারই খণ্ডচিত্র ফুটে ওঠে ‘লিমিট’ তথ্যচিত্রে। শুরুতে করোনা কালের অভিজ্ঞতার ভয়েজ ক্লিপগুলো শুনতে কিছুটা খটমটে লাগে। সাউন্ড কোয়ালিটি ঠিক মসৃণ নয়। তবে উত্তর খুঁজে নিতে সময় লাগে না। অবরুদ্ধ দিনে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেনে চলা মানবজীবনে নিত্যকার শব্দগুলোই এখানে কাঁচামালের মতো জুড়ে গিয়েছে। যদিও আমরা জানি মহামারীর আধিপত্য সবার আগে ছিনিয়ে নেয় প্রাণ। অবক্ষয় ঘটায় মূল্যবোধের। জাগিয়ে তোলে নিপাট স্বার্থপরতা। জানি এ যুদ্ধের হয়তো কোনো শেষ নেই। তারপরেও, সকলে জীবনে চায় চকলেটের বাক্স কিংবা লাল গোলাপের তোড়া। তারপরেও, বাঁচতে চায় সুন্দর দিনের অপেক্ষায়। আর দর্শক হিসেবে দেবাশিষ মজুমদার ও তার টিমের কাজটুকুকে মনে হয় বর্তমানের বিশ্বজনীন চিত্র। আর মনে হয়, এমন চেনা অথচ তরতাজা স্ক্রিপ ও ফিল্মের দৈর্ঘ্যটুকু আরেকটু মেদহীন হলেই শেষ দৃশ্য; কর্ণফুলি ব্রীজের ওপর উন্মুক্ত আকাশে স্লো মোশনে রাজ্যের পাখিদের অনন্তে উড়ে যাওয়ার মতো এটি পারফেক্ট হবে।
Limit – A Film by Debasish Mazumder A production of Chitrobhasha Gallery (www.chitrobhasha.org)