Blog

আমি যা লিখি, তুমি তা দেখো

বুকে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে বই পড়া পুরানো বদভ্যাস। পায়চারী করতে করতে পাতার পর পাতা উলটে যাওয়াও নতুন কিছু নয়। কিন্তু, যেইসব দিনে কোটি মানুষের পৃথিবীতে আমাদের নিজেদের সবচেয়ে একা লাগে, তখন বৃদ্ধ হয়ে আসা আকাশটা অন্ধকারে ডুবতে করে সাহায্য। আলোতে অস্বস্তি হয়। ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসা ঘোলাটে পৃথিবীতে নিজেকে মনে হয় বৃত্তবন্দি।

বিখ্যাত ‘কিভাহান’ থেকে ‘পেনি ইউনিভার্সিটি’র নাম উজ্জ্বল রাখতে ঘরবন্দি দিনে কড়া কফি যেন নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। মানসিক অবসাদের হাত ধরে; শেয়ার করা জিফ কিংবা জিরাফের মতো আকাশের দিকে মুখ উঁচু থাকলে বেনামী বাতাসের মতো, অদ্ভুত এক শূন্যতা ছেয়ে যায় মনে। দেয়ালে ঝিমায় লালন, নজরুল, জন লেনন। বাইরে উইন্ড চাইম সিক্রেট কনফেশনের মতো মৃদু শব্দ তোলে। মোবাইলে মেলানকোলিক ওয়েদার ফোরকাস্ট, মেঝেতে কিছুদিন আগে কেনা শুকনা গ্রোসারি, পুরানো ম্যাগাজিন, স্প্যানিশ গিটার, টেবিলে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ইয়ারফোন, আধখোলা বই ও বুকমার্ক। সারাদিন অভুক্ত থাকার পর সন্ধ্যার খাবারটুকু খেয়ে, কাউচে চোখ বুজে আনরীড অপশনে ক্লিক করলে, কোনো এক এ্যালবাম আর্টের টুকরো ছবি প্রবল ইলুশ্যন আনে। যেন চলন্ত গাড়ি থেকে কেউ হ্যাঁচকা টানে এনে দাঁড় করিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো, রহস্যময় বনভূমির চাইতেও গহীন অরণ্যের সামনে।

আর পেন্ডুলামের মতো ডানে-বামে ভাসতে ভাসতে জেনে যাই, আমার মতোই কোনো এক লুসি বাড়ি ফিরে আসার সময় চেনা রাস্তা উপেক্ষা করে পিছু নিয়েছে দীর্ঘ পথের।

‘Lucy takes the long way home
Meets me in a field of stone’

সাদা পোশাকের লুসিকে আয়নার মতো চিনে নিতে গিয়ে আমিও নিজেকে মনে করি, মানুষ নয় বরং আরেক ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। দ্য মর্ডান প্রমিথিউস। আঁধারের মাঝেও আমার শরীরের একটা বিশাল ছায়া পড়ে ঘরের এক প্রান্তে। বাইরে পাখি ডাকে। কাঠের বারান্দা ছাপিয়ে কার্পেটের মতো সবুজ ঘাসে সন্ধ্যাবেলা ঝরে নির্লিপ্ত কুয়াশা। বাতাস থমকে যায় কিছুটা। মনে হয় ছায়াটুকু যেন অচল এক বিষণ্ণ ট্রেন। যা লিভিংরুম থেকে বারান্দার দূরত্ব অতিক্রম করলেই চলে যেতে পারবে বহুদূর। কিন্তু লুসি বলে,

‘life’s a game we are meant to lose
Stick by me and I will stick by you’

এমন বিপন্ন সন্ধ্যায় মুখস্থ করা পুরানো কবিতার লাইন, বই কিংবা নোটবুককে গুডবাই জানাতে বাধ্য হোই। অচল ট্রেন খুঁজে পায় না কোনো জংশন। তাই হলুদে খামের ওপর ডাকটিকেটের মতো সেঁটে থাকা হয় লুসির সাথে।

‘I’m like a princess waiting in a castle high
Waiting for a kiss to bring me back to life.’

সন্ধ্যাকালীন কুয়াশা ভেদ করে বহু দূরের আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। শুরু হয় ক্লান্তির সুর। একটি বিজন ঘরে স্বচ্ছ জানালার কাচের আড়ালে; লুসি আর আমি দুজনেই বিষাদের ধোঁয়ায়, শূন্যে সাঁতার কাটতে কাটতে বুঝে যাই, যত বড়ো রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর। কখনও ছিলও না।

লুসি। লুসি। জেরেমীর লুসিকে খুব চেনা মনে হয়। যে হারিয়েছে আপন কাউকে, যে ফেলে এসেছে অনেক কিছু। শুকনা গোলাপের সুবাসে যার মনে পড়ে অতীত নামের ভিনদেশ। যে ভাবে; যা আমাদের আছে তা মনে হয় অনেক দূরের, যা মিলিয়ে গেছে তাই হয়তো বাস্তব। যে নিজেও শরীর, মন, মনের সবচেয়ে বাইরের অংশ, প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলোকে ল্যান্ডস্কেপের মতো এঁকে অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে ফেলতে চায়।

লুসি কি ট্রল নাকি ক্যাজুয়াল সন্ধ্যার মিরাকল? যে আবারও নাগরদোলার মতো ঘুরে এসে; চেনা পথ ফেলে হাঁটছে দীর্ঘ পথে!

লুসি কি ক্যাপাচিনোর ওপর নকশা করা হৃদয়ের বুদবুদ?

লুসি কি অবেলায় আকাশ উপচে পড়া অনর্থক বৃষ্টি? দুপুরের মায়ারোদ? আদরের নৌকা? দূরের তারা? চঞ্চল বাতাসের স্পর্শ? নাকি পেয়ারার সুবাস? কেন না চাইতেও; অচেনা টানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিঃশব্দে ওর পিছু নিতে হয়?

অনাহূত অতিথির মতো আসা লুসি কি জানে,

চলে গেছে দিন-সময়-বছর তারপরেও, কখনও এমনিভাবে আমার করে, নিজেকে আমি আগে ভাবিনি…

Art – The Reluctant Graveyard by Jeremy Messersmith 2010
Song- A Girl, a Boy, and a Graveyard

লেখাটি নিয়ে মন্তব্য প্রদান করুন।

Your email address will not be published. Required fields are marked *