Blog

slider-02-1.png

প্রত্যাবর্তন

আকাশটা মেঘ মেঘ হয়ে ছিল। ভোরের আলোটুকু এলো নিঃশব্দে। যেন চুরি করে তার উপস্থিতি জানাচ্ছে। হালকা রোদ পেয়ে উঠোনের গাছগুলো তখন আকাশমুখো। বাতাসে নিশ্চুপ ঘ্রাণ। কলতলা থেকে পানি পড়ছে টপ টপ। একটা শালিকপাখি একা একা বসে আছে ডালিম গাছের ডালে। ডালটা দুলছে মৃদু। রাত হলেই হয়ত এই গাছের চারপাশে সোনাপোকাদের আড্ডা বসে। অথচ দিনের বেলায় তারা কেউ নেই। রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসে। সাথে গরম তাওয়ায় পরোটা ভাজার ঘ্রাণ। আমি আর মোসাদ্দেক ভাই বসার ঘরে বসে থাকি। দেয়ালে বিশাল বড় একটা নকশি কাঁথা ঝুলছে। কালো কাপড়ে নানা সূতার কাজ। ঘরের মাঝখানে কাচের টেবিলে বাসি খবরের কাগজ। মেঝেতে কিছু চানাচুরের গুঁড়া পড়ে আছে। সোফার দু’পাশে বিবর্ণ কুশন রাখা। উসখুস করতে শুরু করি দু’জনে। আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? মিনিট পাঁচেক পর অনিমার মা পরোটা আর চমচম নিয়ে আসেন। তারপর বলেন, ‘অনিমা তো বাড়ি নেই। তোমরা নাস্তা করো।’

আমাদের আর বলা হয় না, অনিমা বাড়ি ফিরবে না কখনওই।

আগন্তুক

আলমবাড়ি থেকেই লোকটা অনুসরণ করছে। বাসস্টপে এসে ঘুরে তাকাতেই কাষ্ঠহাসি হেসে বলে, ‘সিগারেট আছে?’

রুবেল বিরক্ত হয়ে বলে, ‘নাই।’

‘লাইটার?’ এবার আর অসম্মতি জানানো যায় না। লাইটার পেয়ে পকেট থেকে আধখাওয়া সিগারেট বের করে ফস করে আগুন জ্বালায় লোকটা। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যেন আনমনা হয়। রুবেল মুঠোফোনটা বের করে সময় দেখে। এখনও বাস আসতে কিছুক্ষণ বাকি।

হঠাৎ একটা শিশুর কান্নার শব্দ ভেসে আসে। পাশের বেঞ্চিতে একটি ঝুড়ি রাখা আর তাতে বড় বড় চোখের ফুটফুটে একটি নবজাতক শিশু কাঁদছে তারস্বরে। আশেপাশে মা-বাবা কেউ নাই। ভিড় জমে যায় নিমিষেই। শিশুটি ক্ষুধার্ত। কেঁদেই যাচ্ছে। কান্না শুনে আহা-উঁহু করে সকলে। একজন মৃদুস্বরে বলে, ‘কেউ ওর দায়িত্ব নেন।’

সাথে সাথেই গুঞ্জন উঠে চারপাশে,
‘পোলা নাকি মাইয়া?’
‘হিন্দু না মুসলমান?’
‘নিশ্চয়ই কোন পাপের ফসল। তাই ফালায়া গেছে।’

ভিড়টা খানিক পরেই পাতলা হয়ে আসে। রুবেল দেখে, সেই লোকটা যেয়ে বসেছে শিশুটির পাশে। শক্ত করে ধরেছে ঝুড়ির এক প্রান্ত।

আগন্তুক নিমিষেই যেন দেবতা হয়ে ওঠে।

পনের জুন

আজ পনের জুন। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। ভেলভেটের মতো নরম নয়নতারা ফুটেছে বাগানে। কোণার ঘর থেকে কোরআন তিলাওয়াতের মৃদু সুর ভেসে আসছে। ছাতাটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো সে। এই দিনটা এলেই ভেতরে ভেতরে বড় ভাঙন কাজ করে। পূর্বদিকের তিনটি আমগাছ, কিছু নারিকেল গাছ পেরিয়ে স্তব্ধ গলির শেষে ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটার সামনে গেলো। বাড়িটা পরিত্যক্ত। উঠানে বড় অযত্নে বেড়ে উঠেছে তুলসী গাছ। এ গাছের নিচেই বিবস্ত্র করা হয়েছিল নীপাদিকে। আলতো করে গাছটাকে ছুঁয়ে বের হয়ে গেলো সে। অদূরেই স্কুল শিক্ষক রোজারিও চাচার এক কামরার ঘর ছিল। সেই ঘরে এখন চিপস বিক্রির কারখানা। এই ঘরের সামনেই গুলি করা হয়েছিল তাঁকে। পরম মমতায় দেয়ালে হাত বুলিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। এতক্ষণে কোরআনের সুর থেমে গিয়েছে। সেলাই মেশিন আর কাঁচির শব্দ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। গত আটচল্লিশ বছর ধরে পতাকা সেলাই করে যাচ্ছে এ বাড়ির অন্য সদস্য। যে পতাকা বাঁচাতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ।

যাকে আজও খুঁজে ফেরে তারা।

লেখাটি নিয়ে মন্তব্য প্রদান করুন।

Your email address will not be published. Required fields are marked *